একজন মানুষের অনেক প্রতিভা থাকে, থাকে অনেক সম্ভাবনা। পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্য দিয়ে দু’চারটি প্রতিভা ও সম্ভাবনা নিয়ে মানুষ বড়ো হয়, প্রতিষ্ঠিত হয়, বিখ্যাত হয়। তখন আরো আরো প্রতিভা ও সম্ভাবনা বেঁচে থাকে সময়ের আশ্রয়ে, সুযোগের অপেক্ষায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন, রহম করুন। তিনি বিখ্যাত হয়েছেন একজন কিংবদন্তী নেতার পরিচয়ে। তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশের স্বাধীনতা অর্জনে প্রাণপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর এই পরিচয় সবাই জানে। কিন্তু তার ছিলো আরো আরো প্রতিভা। যে প্রতিভাগুলো সময় ও সুযোগের দৌড়পাল্লায় অগ্রসর হতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধুর যেমন ছিলো নেতৃত্বের বলিষ্ঠহস্ত, ছিলো লেখালেখিরও একটি দীর্ঘহাত। মাঠে-ময়দানে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সেই হাতও তিনি চালিয়েছিলেন সময় করে, সুযোগ করে। সময় ও সুযোগের দৌড়পাল্লায় অগ্রসর হতে পারলে তিনি হয়তো আরো লিখতেন; রাজনীতি সচেতন মানুষদের আরো উপকৃত করতেন।
বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য লেখকীর্তি হলো তার তিনটি বই— ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এই তিনটি বইয়ের মাধ্যমেই ব্যাপকভাবে আমরা জানি—তিনি লিখতেন। তবে তার লেখালেখির পরিধি ছিলো আরেকটু বিস্তৃত।
তিনি রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সাংবাদিকতা করেছিলেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের কাগজ ‘সাপ্তাহিক মিল্লাত’-এ লিখতেন তিনি। অনিয়মিতভাবে লিখেছেন ‘ইত্তেহাদ’ এবং ‘ইত্তেফাক’-এ। তিনি নিজে ১৯৫৬ বা ১৯৫৭ সালের দিকে সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’ নামে একটি পত্রিকাও বের করেন। এই পত্রিকায় তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক এবং কবি জুলফিকার ছিলেন সম্পাদক।
৫৪ বছরের জীবনে বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবন কেটেছে দীর্ঘ সময়। বৃটিশ আমলে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় সাতদিন কারাভোগ করেন। পাকিস্তান আমলে জেল খাটেন ৪ হাজার ৬৭৫ দিন। অন্তত বার বারে মোট জেল খাটেন ৪ হাজার ৬৮২ দিন। বঙ্গবন্ধুর প্রকাশিত তিনটি বই-ই তিনি কারাজীবনে লিখেছেন। একটি লিখেছেন ১৯৫৪ সালের কারাজীবনে, দুটি লিখেছেন ১৯৬৬-৬৯ এর কারাজীবনে।
১৯৫৪ সালের কারাজীবনে লিখেছেন ‘আমার দেখা নয়া চীন’। এ বইয়ে তিনি ১৯৫২ সালের চীন সফরের খুটিনাটি তুলে ধরেন। ইতিহাস এবং ভ্রমণকেন্দ্রিক লিখিত হলেও এতে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন অর্থনীতি, রাজনীতি, বৈষম্য, সামাজিক বৈচিত্র, বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশ্ব বাস্তবতা ইত্যাদির চিত্র। একজন রাজনৈতিক নেতার কলমে এ বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতির পাঠ হয়ে উঠেছে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছেন ১৯৬৬-৬৯ সালে রাজবন্দি থাকাকালে। লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে। এই বইয়ে তার বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজে শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার এবং কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, দেশভাগ, মুসলিম লীগের রাজনীতি, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। পরিবার; পিতামাতা সন্তান-সন্ততি এবং সহধর্মিণীর কথাও উঠে এসেছে এতে। এই বইয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। বইটি এ পর্যন্ত ইংরেজি, উর্দু, জাপানী, চিনা, আরবী, ফরাসী, হিন্দি, তুর্কি, নেপালী, স্পেনীয়, অসমীয়া ও রুশ ভাষায় অনুদিত এবং প্রকাশিত হয়েছে।
একই কারাজীবনে তিনি দিনলিপিও লিখেছিলেন। তার দিনলিপির ডায়েরিটি প্রকাশ পায় ‘করাগারের রোজনামচা’ নামে। এই নামটি মুজিবকন্যা শেখ রেহানার দেয়া। এ বইয়ে ফুটে উঠেছে তার জেলজীবন, জেলযন্ত্রণা। ফুটে উঠেছে কয়েদীদের অজানা কথা, অপরাধীদের অপরাধ জগতে পা রাখার রহস্য, প্রকৃতিপ্রেম, পিতৃমাতৃ ভক্তি, কারাগারে পাগলদের সুখদুঃখ, হাসিকান্না। মুখ্যভাবে উঠে এসেছে তখনকার দেশ ও দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও জিঘাংসা, স্বাধীনতাকর্মীদের জেলজীবনের দুঃখদুর্দশা, গণমাধ্যমের শোচনীয় চিত্র ও মিডিয়াবাজি, শাসকগোষ্ঠীর নিমর্ম জুলুম-নির্যাতন এবং নীতিহীনতা, ছয় দফার আবেগ এবং এ নিয়ে নানামুখী খেলা, রাজনীতির নানা সূ² কৌশল, বিভিন্ন মতাদর্শের নেতার প্রতি তার মানসিকতা, আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীনতার দৃষ্টান্ত ইত্যাদি। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লেখাগুলো এই বইয়ে প্রকাশ করা হয়। বইটি এ পর্যন্ত ইংরেজি এবং অসমীয় ভাষায় অনুদিত হয়।
শুরুতেই বলেছিলাম, মানুষের কিছু প্রতিভা ও সম্ভাবনা প্রকাশের জন্য সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়। বঙ্গবন্ধুর লেখ-প্রতিভা সেই সময়ের অভাবে খুব বেশি সামনে আসেনি। জেলটুকু না খাটলে যতটুকু সামনে এসেছে, তা-ও বোধ করি আসতো না। ভিন্নকথায় রাজনীতির সাথে তিনি সাহিত্য চর্চাও ভালো করতে পারতেন। কিন্তু সময় তাকে এ পথে আনেনি।
কারাভ্যন্তরের নিয়মকানুন, শাসনপ্রণালী, পরিবেশ এবং কারাবন্দীদের জীবনের বিচিত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাবলী নিয়ে কারাসাহিত্য নির্মাণ হয়। বাংলা সাহিত্যে কারাসাহিত্যের বেশকিছু স্মরণীয় বই আছে। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘পাষাণপুরী’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’, সমরেশ বসুর ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ এবং ‘স্বীকারোক্তি’, জরাসন্ধের ‘লৌহকপাট’, ‘তামসী’, ‘ন্যায়দণ্ড’, সরোজকুমার রায় চৌধুরীর ‘শৃঙ্খল’ ইত্যাদি। সে অর্থে বঙ্গবন্ধুর দুটি বই— ‘আমার দেখা নয়া চীন’ এবং ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কারাকেন্দ্রিক নয়। ‘কারাগারের রোজনামচা’ পূর্ণ অর্থে কারাকেন্দ্রিক না হলেও, অথবা কারাসাহিত্যের উপাদানগুলো এই বইয়ের প্রধান উপজীব্য না হলেও এতে কারাগারের নানা কিছুর পরিচয়সহ কারাসাহিত্যের সব উপাদানই স্থান পেয়েছে। যেহেতু জেলখানায় বসেই জেলখানার রোজনামচা লিখেছেন, তাই বইয়ের প্রায় সবকটি লেখায় এর উদাহরণ পাওয়া যায় স্বাভাবিকভাবেই। এমনকি বইয়ের শুরুতে তিনি কারাভ্যন্তরে প্রচলিত বিভিন্ন পরিভাষার পরিচয়ও দিয়েছেন। এই সৃজনশীলতাটি একদিকে লেখালেখিতে তার মুন্সিয়ানার পরিচয় প্রকাশ করেছে, অপরদিকে বইটিকে কারাসাহিত্যের কাতারে আরো উন্নীত করেছে। আমরা এ বইটিকে কারাসাহিত্যের কাতারেও রাখতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর লেখা সাবলীল। মনে হয়—কথাশিল্পীর মতো কথা বলছেন। লেখায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার হয়েছে অনেক। রয়েছে সাধু-চলিতের মিশ্রণ। তবে এসবের কারণে পাঠে ধাক্কা আসে না। পড়তে পড়তে মনে হবে— গল্প শুনছি। বস্তুত আত্মজীবনী এবং ডায়রী লেখা এমনই হয়ে থাকে। রাজনীতিতে আগ্রহীরা তার বইগুলো পড়ে অতৃপ্ত থাকবে, আরো পড়তে চাবে; ভাষা সাহিত্য বা রচনাশৈলীর জন্য না হলেও রাজনীতির গল্প ও অভিজ্ঞতা জানার জন্য। তিনি যদি আরো লিখতেন, রাজনীতিতে আগ্রহীরা আরো উপকৃত হতো। কিন্তু একজন তুখোড় নেতার জন্য এ-ই তো অনেক বেশি! এরচে বেশি তার সুযোগ কোথায়!