এখনো চোখ বুজলেই দেখতে পাই দুর্গা আর অপু গ্রামের পথ ধরে দৌড়াচ্ছে। আর সাদা কাশফুলগুলো উড়ছে বাতাসে। দূরে শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল! ট্রেন আসছে। ওরা ট্রেন দেখবে বলে কাশফুল মাড়িয়ে পৌঁছেছিল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে দৃষ্টি থেকে বেরিয়ে গেছে ট্রেনটি। ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যকাব্য কার না মনে আছে।
শরৎ ঋতুর কথা মনে এলেই আমাদের চোখের কোণে ভেসে উঠে ফুটন্ত সাদা কাশফুল, পাল তোলা নৌকার সারি, দূর আকাশের কোণে জমে থাকা ধূসর সাদা মেঘের ভেলার কথা। কখনো মিষ্টি রোদে আলোর খেলা আবার কখনো হঠাৎ বৃষ্টির হানা। মাঝে সাজেই দেখা যায় রৌদ্র মেঘের লোকুচুরি খেলা।
শারদ বিকেলে একগুচ্ছ কাশফুল স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে যায়, হাতের স্পর্শ পৌঁছে যায় হৃদয়ে … শরতের কাশফুল অগোচরে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় তরুণ তরুণীর মনে। শারদীয় বিকেলগুলো শুধু কাশফুলের জন্যই হয়ে ওঠে মনোরম। নদীর ধারে, জলের ধারে, উপকূলেই এই ফুল স্বমহিমায় নিজেদের জানান দিয়ে যায়।
ঢাকার উপকণ্ঠে বালুকাময় জল উপকূলে ফুটেছে রাশি রাশি কাশফুল। ঢাকার কেরানীগঞ্জ, দিয়াবাড়িসহ ঢাকার উপকণ্ঠের নানাপ্রান্তে শারদ মধ্যপ্রান্তে রাশিরাশি শ্বেতশুভ্র কাশফুল এখন নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে। আর এই মৌসুমী কাশফুলের মহিমা পৌঁছে গেছে সুদূর বিদেশে। চীনের একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ঢাকার উপকণ্ঠে ফোটা এই কাশফুল কয়েক কলম লিখেছে। বর্ণনা করার চেষ্টা করেছে শরতের সৌন্দর্য।
ঋতুর রানি শরৎ। কাশফুল একেবারেই প্রাকৃতিক। ইদানীং কয়েকটি এলাকা ছাড়া এর নেই কোনো চাষবাস, নেই কোনো যত্ন-আত্তি। নদীর ধার কিংবা বিস্তীর্ণ বালুচরে বড্ড অবহেলায় ফোটে এই শরতে। দূর থেকে কাশের বনে তাকালে মনে হয়, শরতের পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে ধরণির বুকে। একটু বাতাস পেয়ে দলে দলে কাশফুল যখন এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়, তখন মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
সাদা কাশফুলের মঞ্জরি ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা। বীজে সূক্ষ্ম সাদা রোম। ঘাসের জ্ঞাতি কাশ হয় তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা। ঘাসের মতোই এর মূল গুচ্ছ। পাতা রুক্ষ ও সোজা রেখার মতো। লম্বায় আধা থেকে এক মিটার আর চওড়া ছয় থেকে ১৫ মিলিমিটার। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব এলাকায়ই কাশফুল দেখা যায়।
সত্যজিৎ রায়ের পথের ‘পাঁচালী’ ছবির কথা মনে আছে? কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অপু আর দুর্গা। কাশবনের এই দৃশ্যটা নেওয়ার জন্য বছরখানেক সময় লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের। তুমুল বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল কাশবনের সৌন্দর্য। তার পরের বছর আবার সেই একই জায়গায় কাশফুল ফোটার অপেক্ষায় থেকেছিলেন তিনি।
কবি নির্মলেন্দু গুণ তো নিজের গ্রামের নামই বদলে রেখেছেন ‘কাশবন’। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে কবির জন্মস্থান গ্রামের নাম ছিল কাশতলা। কাশফুলকে ভালোবেসে কবি রেখেছেন কাশবন।
রবী ঠাকুর তার শরৎ কবিতায় লিখেছিলেন ‘আজি কি তোমার মধুর মূরতি, হেরিনু শারদ প্রভাতে! হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে। পারে না বহিতে নদী জলধার, মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর– ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল তোমার কাননসভাতে! মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী, শরত্কালের প্রভাতে।’ এমন কবিতার পংক্তিমালায় কার মন ছুয়ে না যায়? দিশেহারা হয়ে ছুটে যায় মন কোথায় আছে এমন ধবল সাদা কাশবন?
কাশবনের উপকারের সীমা কেবল পানের বরজ, ঘরের চালা বা সবজিবাগানের বেড়া হিসেবে নয়, কাশফুলের আয়ুর্বেদীয় গুণও আছে। মাটিধস রোধ করতে চাষ করা হয়। আখের অঙ্কুরোদ্গম ছাড়াও বিশেষ ধরনের কাগজের মণ্ডও তৈরি হয় কাশ থেকে। সব মিলিয়ে কাশফুল কেবল শরতের মুগ্ধতার প্রতীকই নয়, আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কাশের জীবন।